চট্টগ্রাম বন্দরের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট-১) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন। যাকে দুর্নীতির বরপুত্র বলা চলে।
নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সমালোচিত ওই এস্টেট কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বন্দরে ২০১৮ সালের ৭ মার্চ সহকারী ব্যবস্থাপক (ভূমি) পদে চাকরিতে যোগ দিলেও অনিয়মের টাকায় ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট থেকে ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট-১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
তার বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, ফাইল নাড়াছাড়া, দীঘি ইজারাসহ বন্দরের নানান অনিয়মের অভিযোগ।
বন্দরে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তার মুখে মুখে শোনা যায়-ঘুষ, দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে গেল কয়েক বছরে শিহাবউদ্দিন টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। মোটা অংকের লেনদেনে নড়ে-চড়ে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল,ভরে তার পকেট।
তাছাড়া মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাসাতে ফ্যাসিবাদের দোসরদের অর্থ দেয়াসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।
তবে গত বছরের ২০ আগষ্ট রাজধানীর বনানী থেকে দুর্নীতি, গুম এবং হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠা চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলকে গ্রেপ্তারের পর শিহাবের দৌড়াত্ম্য কিছুটা কমে আসে।
বেশকিছুদিন নিজেকে আড়ালও করে রাখেন গ্রেপ্তার সোহায়েলের ক্যাশিয়ার হিসেবে আলোচিত মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন। তবে সম্প্রতি নতুন খোলস পাল্টে সে আবারও মাথা চড়া দিয়ে ওঠেন।
চট্টগ্রাম বন্দরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে ফ্যাসীবাদী স্বৈরাচারী সরকারের পতন হলেও তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় গত ১৬ বছরে তৈরি হওয়া লুটেরা এখনও চট্টগ্রাম বন্দরে সক্রিয় রয়েছে। এসব ফ্যাসীবাদের দোসররা ভিতরে ভিতরে নানান ছল চাটুকারিতায় পুনরায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
জানা গেছে, আ.লীগের বিভিন্ন গ্রুপ মেইনটেইন করে আসা মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন আ.লীগের ঘনিষ্ট একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিরাট অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। বিনিময়ে বন্দরকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।
কয়েকজন নব্য সিবিএ নেতাকে সামনে এনে বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ড বেসরকারীকরণ করা যাবে না/বিদেশীদের অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া দেয়া যাবে না বলেও শ্লোগান তুলছে। অথচ ২০০৬ সাল থেকেই এনসিটি ইয়ার্ড পরিচালনা করে আসছে বেসরকারী প্রতিষ্ঠান।
শিহাবের এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বিপদে পড়ার ভয়েও বন্দর কর্মকর্তারা সাহস পায়না। কারণ বন্দর এলাকায় কিশোরগ্যাংয়ের লিডার হিসেবে পরিচিত পরিবহণ বিভাগের প্রধান সহকারী রফিকুল ইসলাম (সেতু)র ঘনিষ্ঠ সহচর সাবেক সিবিএ সাধারণ সম্পাদক নায়েবুল ইসলাম ফটিকের সাথে শিহাবের রয়েছে নিয়মিত যোগাযোগ।
তাদের পরস্পরের যোগসাজশে বন্দর ও সরকারকে অস্থিতিশীল করার সুস্পষ্ট চক্তান্ত চলছে বলে মনে করেন অনেক কর্মকর্তা।।
তাদের মতে, চক্রান্তের অংশ হিসেবে গত ২৩ এপ্রিল বন্দর উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন এসএসসি পরীক্ষার্থী বাসে “জয় বাংলা” স্লোগান দেয়ার মতো দুঃসাহস করে।
আর সেটি ফেসবুকে ভাইরাল করে পুরো বন্দর এলাকা তোলপাড় করে দেয়া হয়। এটি তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রলীগের অফিসিয়াল পেইজে আপলোড দেয়া হয়।
এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী সরকার পতনের ছয় মাস পেরোলেও শিহাবের বিষয়ে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বর্তমান প্রশাসন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এ নিয়ে সচেতন কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
তাদের মতে স্বৈরাচারের দোসররা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এখনও বহাল রয়েছে। তারা অর্থ দিয়ে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করতে নানা অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের একজন বন্দরের এস্টেট কর্মকর্তা মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে অর্থ আত্মসাৎ ও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম বন্দরের এক কর্মচারী দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছে।
অভিযোগের অনুলিপি দেওয়া হয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব, বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, দুদক চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক এবং বন্দরের এনএসআইয়ের উপপরিচালক বরাবর।
অভিযোগে বন্দর কর্মচারী উল্লেখ করেন,সীতাকুণ্ড ভাটিয়ারি এলাকায় সমুদ্রঘেঁষা হাজার হাজার একর জায়গা রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের। সেখানে দুই কিলোমিটার জায়গাজুড়ে বসুন্ধরা গ্রুপ জেটি করতে আবেদন করেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাবর।
কিন্তু এই কাজটির ফাইল প্রসেসিংয়ের কাজের দায়িত্ব পরে এস্টেট অফিসার শিহাব উদ্দিনের ওপর। নানা টালবাহানা ও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ভাটিয়ারীর সমুদ্র তীরে বসুন্ধরা গ্রুপের জেটি করিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মোটা অংকের ঘুষ দাবী করেন তিনি।
এছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝির দিকে চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলায় এসএ সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জেটি এবং স্লিপ ওয়্যার ভাড়া কমানোর জন্য ফাইল প্রসেস করতে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। এই ফাইলটিও প্রসেসের দায়িত্ব পড়ে শিহাব উদ্দিনের কাছে।
সেখানে ওই কোম্পানি থেকেও মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে কাজ করে দেন বলে গুঞ্জন উঠেছে এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
অভিযোগে বন্দর কর্মচারী আরও উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী পশ্চিম গোমদন্ডী বোয়ালখালী মেসার্স কনফিডেন্স সল্ট লিমিটেডের জেটি অনুমোদনের ফাইল প্রসেসিংয়ের জন্য যায় বন্দর এস্টেট বিভাগে। সেটির কাজ বাস্তবায়নে প্রধান দায়িত্বে ছিলেন বন্দরের ডেপুটি এস্টেট অফিসার শিহাব উদ্দিন।
জেটি অনুমোদনের কাজটি করতেও শিহাব উদ্দিন মোটা অংকের ঘুষ নিয়েছিলেন আর ঘুষের লেনদেন করেন তার ছোট ভাইকে দিয়ে। যাকে চট্টগ্রাম বন্দরে হাফেজ নামে চেনেন সবাই।
এদিকে গত অর্থ বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে এমইবি ইন্ডাস্ট্রিজ কমপ্লেক্স লিমিটেড ও ইলিয়াস ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড নামের এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘদিন ধরে ফাইল নবায়নের কাজ আটকে ছিল।
কিন্তু ডেপুটি এস্টেট অফিসার শিহাব উদ্দিন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এই কোম্পানির কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ঘুষ নিয়ে ফাইল নবায়নের কাজ করে দেন। এই দুই প্রতিষ্ঠানই ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, সমুদ্র ঘেঁষে উঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ নির্দেশনা দিলেও বড় অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে পতেঙ্গা নেভালে সমুদ্র তীরে অবস্থিত বে-ওয়ান ক্রুজের মালিক প্রকৌশলী আবদুর রশিদের জাহাজটি সরানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি ডেপুটি এস্টেট অফিসার শিহাব উদ্দিন।
অনিয়ম-দুর্নীতির ও অভিযোগের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ডেপুটি ম্যানেজার (এস্টেট) মুহাম্মদ শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সব মিথ্যা, বানোয়াট, ভিত্তিহীন। একটি মহল দীর্ঘদিন ধরে তার সুনাম ক্ষুন্ন করতে অপপ্রচার চালাচ্ছে।”
বন্দর কর্তৃপক্ষের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলেন, শিহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে বেনামি চিঠি পেয়েছি, তবে কেউ যদি সরাসরি বন্দর কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দেয় বা প্রতিকার চায় তাহলে বন্দর কর্তৃপক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শিহাবের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ দুদকের উচ্চপর্যায়ের ৪ সদস্যের একটি টিম ঢাকা থেকে তদন্ত করতে আসে। তদন্ত শেষে নানান অনিয়মের অভিযোগে চলতি দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দিয়ে মাতারবাড়ি সমুদ্র বন্দরে বদলীপূর্বক সংযুক্ত করে। কিন্তু শিহাব উদ্দিন থেমে থাকেননি।
আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত ও আওয়ামী আমলে সবচেয়ে বেশি লাভবান ধুরন্ধর এই কর্মকর্তা বন্দর ঘনিষ্ট একটি প্রভাবশালী মহলকে ম্যানেজ করে নিজের কার্যসিদ্ধি করতে তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে তার পদোন্নতির জন্য ক্রমাগত চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বিভিন্ন সন্ত্রাসীদের দিয়ে তিনি সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমানকে প্রাণ নাশের হুমকিও দিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, শিহাবের আচার আচরণে অতিষ্ট বন্দরের অধিকাংশ কর্মকর্তারা। অনিয়মের মাধ্যমে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাওয়ায় তিনি জুনিয়র/সমকক্ষ তো বটেই, সিনিয়র কর্মকর্তাদের তোয়াক্কা করেন না।
চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েলের সময়েও তিনি তার সাথে ওয়ান টু ওয়ান কমিউনিকেট করতেন। কোন সদস্যকেও পাত্তা দিতেন না। যেন তিনিই বন্দরের ভাইস চেয়ারম্যান।
তার উদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের কারণে বন্দরের বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যেত না। কারন তিনি ছিলেন চেয়ারম্যানের কালেক্টর কাম ক্যাশিয়ার।
বন্দরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গড়ে ওঠা বড় একটি সিন্ডিকেট এখনও আরও বেপরোয়া। এর ফলে বন্দরের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটের শক্তিশালী জালে আরও বেশি সরকারি অর্থ অপচয়ের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
সবশেষ গত ৫ মে উপ-ব্যবস্থাপক (ভূমি) পদে পদোন্নতির জন্য পদোন্নতি সভা ডেকেছে বন্দর প্রশাসন। তারা আশা করেন, ৫ আগস্টের রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে নতুন করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে কোন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পদোন্নতি দিবে না বন্দর প্রশাসন। যোগ্য ব্যাক্তিকে পদোন্নতি দিয়ে বন্দরের জমি-জমা রক্ষার দায়িত্ব দিবে।
একটি সূত্র জানিয়েছেন, ফটিকের আওয়ামী সিন্ডিকেট বন্দরের বর্তমান চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জমানকে বদলির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে বন্দরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অত্যন্ত বিব্রতবোধ করছেন।
এসব আওয়ামী এজেন্টদের উপযুক্ত শাস্তি না দিলে বন্দরের স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি যেকোন সময় অস্থিতিশীল হয়ে যেতে পারে। তাই বন্দর প্রশাসনের উচিত অতি দ্রুত এসব এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া।
উল্লেখ্য, এ বন্দরের টেন্ডারসহ জাহাজ কেনা, সিসিটি (চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল), আইসিডি অপারেশনে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, জনবল নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও আর্থিক লেনদেনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বন্দর রক্ষা পরিষদের ব্যানারে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়।
দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট ফিরিস্তি দিয়ে সভা সমাবেশ, মিছিল, অনশন, কালো ব্যাজ ধারণের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষ মহলে এবং এর পাশাপাশি দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন), গোয়েন্দা সংস্থা এবং সংসদীয় কমিটির কাছেও লিখিত অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে দুদকের পক্ষ থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে।