Logo
শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:২১ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
রাঙ্গামাটিতে অটোরিকশা-পিকআপ সংঘর্ষে প্রাণ গেল ৬ জনের আনোয়ারায় পুলিশের ওপর হামলার মামলায় গ্রেপ্তার ১ পটিয়ায় ৫শ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের স্থান পরিদর্শণ করলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা চন্দনাইশে নোংরা পরিবেশে খাবার তৈরি: বেকারিকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা মিরসরাইয়ের ওয়াহেদপুরে প্রবাসীর ঘরে মিললো ৬৯ গোখরার বাচ্চা হাটহাজারীতে ভোররাতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধ সৈনিক ফটিকছড়িতে প্রবাসীর স্ত্রীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার সীতাকুণ্ডে বাসে ধাক্কা দিয়ে পিকআপ উল্টে শিশুর মৃত্যু, আহত ৭ ফটিকছড়িতে হত্যা মামলার ৩৪ বছর পর পলাতক আসামি গ্রেপ্তার মিসাইল ধ্বংসের পরীক্ষা চালালো ভারত

বৈসাবি উৎসব ঘিরে পাহাড়ে আনন্দের বন্যা

রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর তিন দিনব্যাপী বিজু-বৈসু-সাংগ্রাই তথা বৈসাবি উৎসব শুরু হয়েছে। উৎসব ঘিরে পাহাড় জুড়ে বইছে আনন্দের বন্যা।

শনিবার (১২ এপ্রিল) সকালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই হ্রদের গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙ্গামাটিতে শুরু হয়েছে চাকমাদের ‘বিঝু’, ত্রিপুরাদের ‘বৈসুক’, মারমাদের ‘সাংগ্রাই’, তংচঙ্গ্যাদের ‘বিসু’ এবং অহমিয়াদের ‘বিহু’ উৎসব।

তবে ত্রিপুরা, মারমা এবং চাকমা এই তিন নৃ-গোষ্ঠীর উৎসবের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে পাহাড়িদের এই উৎসবের নামকরণ হয়েছে বৈসাবি এবং নববর্ষসহ হয় বৈসাবিন।

ভোর থেকে পাহাড়ী নারীরা বাগান থেকে ফুল সংগ্রহ নিয়ে একে একে চলে আসে কাপ্তাই হ্রদে। পুরনো বছরের সব ময়লা, পাপ, বিপদ-আপদ, গ্লানি, ব্যর্থতা ধুয়ে মুছে ফেলতে পানিতে ভাসানো হয় ফুল।

এর মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানানো হয়, নতুন বছরে সবক্ষেত্রে পরিপূর্ণরূপে অর্জন ও শুভ-মঙ্গলের।

সৃষ্টিকর্তার কাছে এমন প্রার্থনা জানিয়ে উৎসবের প্রথম দিন কাপ্তাই হ্রদে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে পানিতে ফুল ভাসিয়ে উৎসবের সূচনা করা হয়।

ভোরে রাঙ্গামাটি রাজবাড়ী ঘাটে বৈসাবি উদযাপন কমিটি উদ্যোগে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে তিন দিনের এই উৎসবের সূচনা করা হয়।

বৈসুক উৎসবের উদ্বোধন করেন, রাঙ্গামাটির সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার। এ সময় সাবেক উপসচিব প্রকৃত রঞ্জন চাকমা, সদস্য সচিব ইন্টু মনি তালুকদারসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

অন্যদিকে, শহরের গর্জনতলী এলাকায় গঙ্গা দেবীর উদ্দেশে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের উদ্বোধন করেন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কৃষিবিদ কাজল তালুকদার।

এ সময় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য রাঙাবি তংচগ্যা, যুব দলের সভাপতি আবু সাদাৎ মো. সায়েম, ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি বিদ্যুৎ ত্রিপুরাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ তিন দিনব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’ দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিজু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা’ দিন বলেন।

আর ত্রিপুরারা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’, দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ বলে।

বৈসাবি উৎসব ঘিরে তিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) বিরাজ করে উৎসবের আমেজ। পাহাড়িরা নানা আয়োজনে উদযাপন করে তাদের সবচেয়ে বড় এই সামাজিক উৎসব।

বৈসাবি উপলক্ষে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকে বৈসাবি উদযাপন কমিটির উদ্যোগে বর্ণাঢ্য আয়োজনে শোভাযাত্রাসহ নানা কর্মসূচী পালন করে। এতে নানা নৃ-গোষ্ঠির নিজস্ব বর্নিল পোশাকে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।

বিঝু: পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে চাকমারা সংখ্যায় বেশি। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভুতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবে সাড়া পড়ে যায় সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে।

উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমারা বলে ‘ফুল বিজু বা ফুল বিঝু’। এই দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় ও সেই ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। দিন শেষে সেই ফুল নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

বিঝুর সময় ছোট ছেলে-মেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পড়ে দল বেঁধে বাড়ি-বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের সম্ভাষণ করেন এবং ঘরের হাঁস-মুরগিকে ধান, চাল ছিটিয়ে খেতে দেওয়া হয়।

এই সময় ঘরে ঘরে রান্না হয় সুস্বাদু ‘পাজন’। হরেক রকম সবজি দিয়ে রান্না করা হয় চাকমাদের বিখ্যাত এই খাবার।

এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার এটি। ছেলে-মেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হা ডু-ডু) খেলায় মেতে ওঠে। তারা আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফুটিয়ে আনন্দ করে। বয়স্করা দেশীয় মদ ‘জগরা বা ‘কাঞ্জি পান করেন।

বিঝু উৎসবের সময় কোনো প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছরই ভালো খাবারের সম্ভাবনা থাকে বলে বিশ্বাস করেন তারা।

বৈসুক: ত্রিপুরাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচে আকর্ষণীয় উৎসব বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্রের শেষের দুইদিন ও নববর্ষের প্রথমদিন উদযাপন করা হয় এই উৎসব।

চৈত্রের শেষ দুইদিনের প্রথম দিনকে ত্রিপুরারা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকে। আর নববর্ষের প্রথমদিনকে তারা বলে ‘বিসিকাতাল’।

উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরা ছেলে-মেয়েরা ফুল তোলে। ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে। ঝুড়িতে ধান নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়।

গৃহপালিত সব প্রাণী ছেড়ে দেওয়া হয় খুব ভোরে। পরিচ্ছন্ন জামা-কাপড় পড়ে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ছেলে-মেয়েরা। বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্য দল গ্রামের প্রতি ঘরের উঠানে নৃত্য পরিবেশন করে।

পাহাড়ে পাহাড়ে বৈসাবির আমেজ প্রত্যেক ঘরের উঠোনে ‘গরয়া’ নৃত্য শেষে শিল্পীদের মুরগির বাচ্চা, চাউল প্রভৃতি দেওয়া হয়।

এসব পেয়ে নৃত্যশিল্পীরা গৃহসত্ত’কে আশীর্বাদ করেন। নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া সামগ্রী দিয়ে গরয়া দেবতার পুজা করে। কোনো শিল্পী যদি একবার এই নৃত্যে অংশ নেন, তবে তাকে তিনবছর পর পর অংশ নিতে হয়। নয়তো তার অমঙ্গল এমনকি মৃত্যুও হয় বলে প্রচলিত ধারণা আছে।

এই লোকনৃত্যে ১৬ জন থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন। এ নৃত্য দেখতে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে ভিড় করে।

সাংগ্রাই: বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ অক্ষরটি অন্যতম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই।

বছরের শেষ দুইদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন এ উৎসব উদযাপন করা হয়। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা বানাতে চালের গুড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা’ বা ‘জলকেলি’ হয়।

সাংগ্রাই উৎসব এবং জলখেলা এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলায় যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে পানি ছুঁড়েন।

এছাড়া, মারমারা বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শোনেন। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এই উৎসব হয়। সেজন্য সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে বলে ধারণা করা হয়।

১৩ এপ্রিল আর চৈত্র সংক্রান্তির দিনকে বলা হয় মূল বিজু। এদিন ঘরে ঘরে রান্না হয় ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাচন’। তা দিয়ে দিন ভর চলে শুধু অতিথি আপ্যায়ন। আর ১৪ এপ্রিল ১লা বৈশাখ উৎসবের তৃতীয় দিন থেকে শুরু হয় মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী জলকেলি তথা পানি খেলা উৎসব।

মাসব্যাপী এই পানি খেলা উৎসবের মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব।

বৈসাবি উৎসবের আনন্দ-উচ্ছ্বাস পাহাড়ের সকল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সম্প্রীত বাড়াবে এমন প্রত্যাশা সকলের।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *


ফেসবুক পেইজ